কোথায় চলেছো? এদিকে এসো না!
দুটো কথা শোনো দিকি,
এই নাও — এই চকচকে, ছোটো,
নতুন রুপোর সিকি।
ছোকানুর কাছে দুটো আনি আছে,
তোমায় দিচ্ছি তাও,
আমাদের যদি তোমার সঙ্গে
নৌকায় তুলে নাও।
নৌকা তোমার ঘাটে বাঁধা আছে –
যাবে কি অনেক দূরে?
পায়ে পড়ি, মাঝি, সাথে নিয়ে চলো
মোরে আর ছোকানুরে।
আমারে চেনো না? আমি যে কানাই।
ছোকানু আমার বোন।
তোমার সঙ্গে বেড়াবো আমরা
মেঘনা, পদ্মা, শোণ।
শোনো, মা এখন ঘুমিয়ে আছেন,
দিদি গেছে ইশকুলে,
এই ফাঁকে মোরে – আর ছোকানুরে-
নৌকোয় নাও তুলে।
কোনো ভয় নেই। – বাবার বকুনি
তোমায় হবে না খেতে,
যত দোষ সব আমরা — না, আমি
একা নেবো মাথা পেতে।
ওটা কী? জেলের নৌকা? — তাই তো!
জাল টেনে তোলা দায়,
রুপোলি নদীর রুপোলি ইলিশ
ইশ, চোখে ঝলসায়!
ইলিশ কিনলে? – আঃ, বেশ, বেশ,
তুমি খুব ভালো, মাঝি।
উনুন ধরাও, ছোকানু দেখাক
রান্নার কারসাজি।
পইঠায় বসে ধোঁয়া-ওঠা ভাত,
টাটকা ইলিশ-ভাজা -
ছোকানু রে, তুই আকাশের রানি,
আমি পদ্মার রাজা।
খাওয়া হলো শেষ, আবার চলছি
দুলছে ছোট্ট নাও,
হালকা নরম হাওয়ায় তোমার
লাল পাল তুলে দাও।
ছোকানুর চোখ ঘুমে ঢুলে আসে
আমি ঠিক জেগে আছি,
গান গাওয়া হলে আমায় অনেক
গল্প বলবে, মাঝি?
শুনতে শুনতে আমিও ঘুমোই
বিছানা বালিশ বিনা —
মাঝি, তুমি দেখো ছোকানুরে,
ও বড়োই ভীতু কিনা।
আমার জন্যে কিচ্ছু ভেবো না
আমি তো বড়োই প্রায়
ঝড় এলে ডেকো আমারে – ছোকানু
যেন সুখে ঘুম যায়।
সিকি — চার আনা মূল্যের মুদ্রা বা ২৫ পয়সার মুদ্রা।
আনি — এক টাকার ষোল ভাগের এক ভাগ মূল্যের মুদ্রা।
শোণ — একটি নদীর নাম।
কারসাজি — কূটকৌশল । এখানে চমৎকারিত্ব অর্থে কাব্যিক ব্যবহার ।
পাল — বাতাসের সাহায্যে চালাবার জন্য নৌকায় খাটানো মোটা কাপড়ের পর্দা।
এই কবিতা পাঠ করার কারণে শিক্ষার্থীদের কল্পনাশক্তির প্রসার ঘটবে। প্রকৃতি ও দেশের প্রতি আকর্ষণ বাড়বে। ভাইবোনের মধ্যে মধুর সম্পর্ক তৈরি হবে।
বুদ্ধদেব বসুর ‘নদীর স্বপ্ন' কবিতায় নদী এবং নৌভ্রমণ নিয়ে এক কিশোরের কল্পনা রূপায়িত হয়েছে। দুরন্ত এক কিশোর তার ছোট বোনকে নিয়ে নৌকাতে উঠে নদীর পর নদী পার হয়ে তাদের মনের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে চায়। নৌকার নানা রঙের পাল, নীল রঙের আকাশ, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির উড়ে চলা, রুপালি ইলিশ মাছ, নৌকায় রান্না করা, সন্ধ্যায় গান গাওয়া, গল্প করা—এত কিছু কিশোর মনে গভীর স্বপ্ন নিয়ে আসে। পাশাপাশি এ কবিতায় বোনের প্রতি ভাইয়ের দায়িত্ব ও আদর প্রকাশের চমৎকার নিদর্শন আছে।
বুদ্ধদেব বসু বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ -কাহিনি, স্মৃতিকথা, অনুবাদ, সম্পাদনা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক (সম্মান) এবং পরের বছর প্রথম শ্রেণিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। প্রথমে সাংবাদিকতা এবং পরে অধ্যাপনাকে তিনি পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ঢাকার পুরানা পল্টন থেকে তাঁর ও অজিত দত্তের যৌথ সম্পাদনায় সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘প্রগতি' (১৯২৭-১৯২৯) প্রকাশিত হয়। তিনি 'কবিতা পত্রিকা' নামেও একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্যরীতির বাইরে পৃথক কাব্যধারার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম প্রধান কবি বুদ্ধদেব বসুর রচনাশৈলী স্বতন্ত্র ও মনোজ্ঞ । বুদ্ধদেব বসু ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বিক্রমপুর অর্থাৎ বর্তমানের মুন্সিগঞ্জে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
ক. তোমার ভালো লাগার স্বপ্ন নিয়ে কবিতা, গল্প বা নাটিকা রচনা কর (একক কাজ)।
খ. 'নদীর স্বপ্ন' কবিতাটির একটি গদ্যরূপ উপস্থাপন কর (দলগত কাজ)।